বৈশি^ক খাদ্য অপচয় ও নষ্ট হওয়া রোধে কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন
ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১ মো. হাফিজুল হক খান২
পরিমিত পরিমাণে খাদ্য আমাদের শরীরের সুস্থতা ও শক্তি প্রদানের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচ্য। শরীরকে ঠিক রাখতে বিভিন্ন খাদ্যপ্রাণ, খনিজ পদার্থ, শর্করা, ¯েœহজাতীয় উপাদানসহ ফাইটোক্যামিক্যালস্ প্রতিনিয়ত আমাদের প্রয়োজন হয়। পুষ্টি নিরাপত্তায়ও খাদ্য বিশেষ করে ফলমূল ও শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও/ডব্লিউএইচও, ২০১৪) সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের জন্য গড়ে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া অত্যাবশ্যক। কিন্তু আমরা দৈনন্দিন প্রায় ২০৪ গ্রাম (২০৮ কিলোক্যালরি) পরিমাণ ফলমূল ও শাকসবজি খেয়ে থাকি, যা প্রায় অর্ধেক পরিমাণ। তন্মধ্যে ১৬৭ গ্রাম শাকসবজি ও বাকি অংশ ফলমূল। বর্তমানে ১৫০ ধরনের উপরে ফলমূল ও শাকসবজি আমাদের দেশে বছর জুড়ে উৎপাদিত হচ্ছে এবং মোট উৎপাদনের শতকরা প্রায় ১ ভাগ প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা খুবই কম অথচ উন্নত দেশে এটি প্রায় শতকরা ৭০-৮৩ ভাগ।
ফলমূল ও শাকসবজিতে অধিক পরিমাণে পানি বিদ্যমান থাকায় খুবই পচনশীল পণ্য হিসেবে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। ফসল কর্তন বা সংগ্রহের পর এর দ্রুত শ^সন চলতে থাকে এবং শরীরবৃত্তিয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সংগ্রহ থেকে বিপণন পর্যন্ত যেকোন স্তরে একটু ক্ষত, থেঁতলে যাওয়া, চাপ খাওয়া বা যেকোনভাবে আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে শ^সনপ্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হয় ফলে প্রচুর গুণাগুণ অপচয়ের কারণে নষ্ট হতে শুরু করে। যথাযথ পরিচর্যা, উপযুক্ত পরিপক্বতায় ফসল সংগ্রহ না করা, যথাযথ মোড়কে না রাখা, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখাসহ উপযুক্ত পরিবহনে স্থানান্তর না করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ ও ক্ষতি হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ এর মতে বিশে^ প্রতিবছর প্রায় ২.৫ বিলিয়ন টন খাবার নষ্ট হচ্ছে যা আর্থিক মূল্য ২৩০ বিলিয়ন ইউ.এস ডলার। আমাদের দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত প্রায় ৯৪ মিলিয়ন টন কৃষিপণ্যের মধ্যে যে সংগ্রহোত্তর অপচয় হচ্ছে তা টাকার অংকে ৩০ হাজার কোটি টাকার উপরে (বিবিএস, ২০২৩)। উন্নত দেশে এই ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হলেও উন্নয়নশীল দেশে প্রায় মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ। ভরা মৌসুমে সংরক্ষণের অভাবে অপচয়ের পরিমাণ অধিক হয়ে থাকে। কৃষক উৎপাদনের খরচ তুলতে না পারায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরে্যা ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তথ্য মোতাবেক আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ১.৪৫ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়। সংগ্রহ থেকে রান্না করা পর্যন্ত নষ্ট হয় ৩৭ লক্ষ টন। উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত আসতে শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ এবং বাসাবাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান এবং রেস্তোরাঁয় শতকরা প্রায় ১৭ ভাগ খাবার নষ্ট হচ্ছে। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অপচয় কমানোর কোন বিকল্প নেই। গত ২০১৪ থেকে পৃথিবীতে ক্ষুধার্থ মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এফএও ২০২৩ এর তথ্য মোতাবেক পৃথিবীর প্রায় ৭৩৫ মিলিয়ন মানুষ চরমভাবে প্রতিদিন ক্ষুধার সম্মুখীন হচ্ছে। শুধুমাত্র এক-চতুর্থাংশ খাবার যদি নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করা যেত তা দিয়ে ৮৭০ মিলিয়ন মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব হতো। উল্লেখ্য যে, আমরা দৈনন্দিন দোকান হতে খাবার হিসেবে যা ক্রয় করছি তারও শতকরা প্রায় ৫.৫ ভাগ নষ্ট করছি যেখানে শতকরা প্রায় ৩ ভাগ খাদ্য ক্রয় ও খাদ্য তৈরির সময় এবং অবশিষ্ট শতকরা প্রায় ২.৫ ভাগ খাবার সরবরাহ ও খাবার প্লেটে নষ্ট হচ্ছে শুধুমাত্র সচেতনতা ও অপ্রয়োজন বা অবজ্ঞায়, যা খুবই দুঃখজনক। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্য মতে, আমাদের দেশে প্রতি জন মানুষ গড়ে প্রতি বছর ৬৫ কিলোগ্রাম খাবার নষ্ট করে থাকে। সব চেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয় আফগানিস্তানে (৮২ কিলোগ্রাম) এর পরে রয়েছে নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ রাষ্ট্রে (৭১-৭৯ কিলোগ্রাম)। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও নিউজিল্যান্ড এ নষ্ট হয় ৫৯-৬৪ কিলোগ্রাম খাদ্য এবং সবচেয়ে কম খাবার নষ্ট হয়ে থাকে ভারত, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্র্রিয়া ও রাশিয়ায় ৩৩-৫০ কিলোগ্রাম। খাদ্য অপচয় বা নষ্ট হওয়া রোধে ৮টি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই পরিমিত খাবার গ্রহণ বিষয়ে নিজে সচেতন হওয়া, খাদ্য গ্রহণের পর অতিরিক্ত খাবার সংরক্ষণ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা, প্রয়োজনীয় খাবার ক্রয় করা, কোন খাদ্যদ্রব্যকেই ক্রয়ের সময় অবজ্ঞা না করা, রেফ্রিজারেটরের ভেতরের তাপমাত্রা যথাযথ আছে কি না তা লক্ষ্য করা, যে খাদ্য দ্রব্যগুলো পূর্বেই সংরক্ষণ করা হয়েছে তা প্রথমেই ব্যবহার করা, খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ের তারিখ লক্ষ্য রেখে ক্রয় ও ব্যবহার নিশ্চিত করা, বর্জ্য বা উচ্ছিষ্ট খাদ্যদ্রব্য যথাযথভাবে রেখে কম্পোস্টে রূপান্তরিত করা। এছাড়াও পচনশীল পণ্যগুলোতে মূল্য সংযোজন করার উদ্যোগ নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফলমূল ও শাকসবজি শুকিয়ে, পাউডার, জুস, ফলসত্ব, ফ্রাইড চিপ্স, চকোলেট ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে সহজলভ্য কৃষিপণ্যের অপচয় থেকে রক্ষা করা যায়। আবার কৃষিপণ্য ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য তৈরির পাশাপাশি উচ্ছিষ্টাংশ থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরি করা সম্ভব। পেকটিন, স্টার্চ, ফুড গ্রেড কালার বা রং, ইথানল, ভিনেগার, সুগন্ধি, ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ইত্যাদি যেমন তৈরি করা যাবে তেমনি রেডি-টু-কুক, রেডি-টু-ইট, ফ্রেশ-কাট, প্রিজার্ভ পণ্যসহ বহুবিধ খাদ্যসামগ্রী অনায়াসে প্রস্তুত করা যায় এবং এগুলো দৈনন্দিন জীবনে সহজলভ্য করা প্রয়োজন। গ্রামীণ জনসাধারণ থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের উদ্যোক্তা লবণ-ভিনেগার দ্রবণ ব্যবহার করে কাঁচা ফলমূল ও শাকসবজি কম খরচে ৬-৮ মাস সহজেই সংরক্ষণ করতে পারে। আবার ফলমূলের পাল্প সংরক্ষণ করা, ভিনেগার দ্রবণে রেখে ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, শসা ইত্যাদি পিকলিং করা লাভজনক এবং বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সাথে ব্যবহার করা যায়। সতেজ ফলমূল (২-৩ মিনিট) ও শাকসবজি (৩০-৪৫ সেকেন্ড বা ১ মিনিট) পরিমিত তাপমাত্রার গরম পানিতে (হাত সহনীয়) শোধন বা স্যানিটাইজিং করে পরে কিছুসময় স্বাভাবিক তাপামাত্রার পানিতে রাখলে এনজাইম নিষ্ক্রিয় হবে এবং পরিমিত পরিমাণে লবণ, অ্যাসিটিক এসিড বা ভিনেগার, সংরক্ষক যুক্ত করলে গুণগতমানও অক্ষুন্নœ থাকবে যা কাঁচামাল তৈরির উৎস হিসেবেও বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে।
পরিশেষে, খাদ্য পণ্যের যথাযথ ব্যবহার ও জনসচেতনতা সৃষ্টিই অপচয় ও নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম ও একমাত্র উপায়, যা সমগ্র বিশে^ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অনস্বীকার্য।
লেখক : ১খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবাইল: ০১৭১২২৭১১৬৩ ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, ই-মেইল: cso.pht@bari.gov.bd ফোন: ০২-৪৯২৭০১৭৬, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১।